ভালবাসার গল্প: পর্ব ১
কলেজ জীবনের সেই দিনগুলোই হয়তো অন্যরকম ছিল। আকাশ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। ভীষণ অন্তর্মুখী, শান্ত স্বভাবের ছেলে। ক্লাস, লাইব্রেরি আর মেসের ঘর—এই ছিল তার জগৎ। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিত না এমন নয়, কিন্তু নিজের একটা কল্পনার জগৎ ছিল তার, যেখানে সে কবিতা লিখত আর আনমনে সুর ভাঁজত।
সেদিন ছিল শ্রাবণের এক দুপুর। সকাল থেকে ঝকঝকে রোদ থাকলেও, দুপুর গড়াতেই আকাশ কালো করে মেঘ জমলো। আকাশ লাইব্রেরি থেকে বের হয়ে সবে হস্টেলের দিকে পা বাড়িয়েছে, এমন সময় ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। দৌড়ে গিয়ে সে আশ্রয় নিল ক্যাম্পাসের কোণায় থাকা ছোট্ট চায়ের দোকানটায়।
চারদিকে বৃষ্টির শব্দ আর মাটির সোঁদা গন্ধ। আকাশ এক কাপ গরম চা নিয়ে আনমনে বাইরে তাকিয়ে ছিল। বৃষ্টির ছাঁট থেকে বাঁচতে অনেকেই তখন দোকানটায় আশ্রয় নিয়েছে। হঠাৎ তার চোখ পড়ল পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির দিকে। নীল সালোয়ার-কামিজে মেয়েটিকে অদ্ভুত স্নিগ্ধ লাগছিল। খোলা চুলগুলো বৃষ্টির জলে ভিজে গেছে, আর কাজল কালো চোখে ছিল একরাশ বিস্ময়। সে বৃষ্টিতে ভিজছিল না, বরং বৃষ্টিকে অনুভব করছিল। দু'হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির ফোঁটা ধরছিল আর হাসছিল আপন মনে।
আকাশের উদাস মনটা কেমন যেন দুলে উঠল। মেয়েটির হাসিতে এমন কিছু ছিল যা তাকে এক মুহূর্তে আকর্ষণ করল। সে আগে কখনো মেয়েটিকে দেখেনি।
হঠাৎ মেয়েটি আকাশের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসল। আকাশ অপ্রস্তুত হয়ে চোখ সরিয়ে নিল। কিন্তু পরক্ষণেই মেয়েটি বলে উঠল, "এই বৃষ্টি সহজে থামবে বলে মনে হয় না, তাই না?"
আকাশ একটু অবাক হয়ে বলল, "হ্যাঁ, তা তো মনে হচ্ছে।"
মেয়েটি আবার বলল, "বৃষ্টি আমার খুব ভালো লাগে। মনে হয় যেন আকাশটা তার সব কষ্ট ধুয়ে দিচ্ছে।"
আকাশ মেয়েটির কথার গভীরতায় মুগ্ধ হলো। সে বলল, "বাহ্! খুব সুন্দর ভাবনা তো।"
"আমি নীলা, ফাইন আর্টস সেকেন্ড ইয়ার,"—হাসিমুখে নিজের পরিচয় দিল মেয়েটি।
আকাশও নিজের পরিচয় দিল, "আমি আকাশ, বাংলা থার্ড ইয়ার।"
"বাংলা! তাহলে তো আপনি কবিতা লেখেন নিশ্চয়ই?" নীলার চোখে তখন রাজ্যের কৌতূহল।
আকাশ লজ্জা পেয়ে বলল, "ওই একটু-আধটু চেষ্টা করি আরকি।"
এর মধ্যেই বৃষ্টির বেগটা একটু কমে এল। নীলা বলল, "আচ্ছা, আজ তাহলে চলি। তোমার সাথে কথা বলে খুব ভালো লাগল, আকাশ।"
নীলা ছাতা খুলে বৃষ্টির মধ্যে মিলিয়ে যাওয়ার পরেও আকাশ সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। তার কানে তখনও বাজছিল নীলার গলার স্বর আর চোখে ভাসছিল সেই কাজল কালো চোখের হাসি। নিজের অজান্তেই তার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল।
পরের দিন থেকে কলেজ চত্বরে আকাশের চোখ দুটো শুধু একজনকেই খুঁজে বেড়াতে লাগল – সেই নীল সালোয়ার পরা মেয়েটিকে, যার নাম নীলা। কিন্তু এত বড় কলেজ, এত ছাত্রছাত্রীর ভিড়ে সে কি আবার খুঁজে পাবে তাকে? এই প্রশ্নটাই তখন আকাশের মনে ঘু
রপাক খাচ্ছিল।
(চলবে...) Nice
ভালোবাসার গল্প - পার্ট ২
(বাস্তবতার মুখোমুখি)
নীলা আর আকাশের ভালোবাসার গল্পটা যেখানে শেষ হয়েছিল, সেখান থেকেই শুরু করা যাক। ইউনিভার্সিটির সেই কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে বসে তারা একে অপরকে কথা দিয়েছিল, হাজার ঝড়েও হাত ছাড়বে না। তাদের প্রেম ছিল অনেকটা কবিতার মতো—ছন্দ মেলানো, সুন্দর আর স্বপ্নময়।
কিন্তু বাস্তবতার মাটি কবিতার নরম ঘাসের মতো নয়, তা বেশ কঠিন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন শেষ হলো। আকাশ একটা ভালো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি পেয়ে ঢাকায় চলে গেল। আর নীলা তার শহরেই একটা কলেজে লেকচারার হিসেবে যোগ দিল। দুজনের মধ্যে তৈরি হলো মাইলের পর মাইল দূরত্ব।
প্রথম প্রথম সব ঠিক ছিল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফোনে কথা, ভিডিও কলে একে অপরকে দেখে নেওয়া, সপ্তাহ শেষে আকাশের ছুটে নীলার শহরে আসা—ভালোবাসার রঙ ফিকে হতে দেয়নি তারা। আকাশ বলতো, "আর কয়েকটা দিন অপেক্ষা করো, নীলা। আমি নিজের পায়ে দাঁড়িয়েই তোমাকে আমার কাছে নিয়ে আসব। আমাদের একটা ছোট্ট সাজানো সংসার হবে।" নীলা সেই স্বপ্নের অপেক্ষায় দিন গুনত।
কিন্তু ধীরে ধীরে সব বদলাতে শুরু করল। ঢাকার যান্ত্রিক জীবন আর কর্পোরেট জগতের চাপ আকাশকে গ্রাস করতে লাগল। তার ফোনকলগুলো ছোট হয়ে এলো। কথার মধ্যে আগের সেই আবেগ আর থাকতো না, থাকতো রাজ্যের ক্লান্তি। নীলা ফোন করলে প্রায়ই সে বলত, "অনেক চাপ যাচ্ছে, পরে কথা বলি?"
অন্যদিকে, নীলার পৃথিবীটা ছিল শান্ত। ছাত্রছাত্রী, কলেজ আর একাকী বিকেল—এই নিয়ে তার জগৎ। আকাশের এই পরিবর্তনটা সে মানতে পারছিল না। তার মনে হতে লাগল, আকাশ হয়তো তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে। দূরত্ব কি তাদের ভালোবাসা কমিয়ে দিচ্ছে? অভিমানের কালো মেঘ নীলার মনে জমতে শুরু করল।
একদিন রাতে নীলা ফোন করে excitedly বলল, "জানো আকাশ, আমার কলেজের পাশে একটা খুব সুন্দর দুই কামরার ফ্ল্যাট ভাড়া হবে। সবকিছু কত কাছে! আমরা চাইলে..."
কথা শেষ করার আগেই আকাশ ক্লান্ত গলায় বলে উঠল, "নীলা, প্লিজ! আমি সারাদিন কাজ করে মরে গেছি। এখন এসব ফ্ল্যাটের কথা শুনতে ভালো লাগছে না। পরে কথা বলব।"
ফোনটা কেটে দিল আকাশ। অপর প্রান্তে নীলার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। এই প্রথম আকাশ তার স্বপ্নকে এভাবে থামিয়ে দিল। তার মনে হলো, যে সংসারের স্বপ্ন তারা একসাথে দেখেছিল, সেই স্বপ্নটা এখন শুধু তার একার।
এরপর কয়েকদিন তাদের মধ্যে প্রায় কোনো কথাই হলো না। একটা অদৃশ্য দেয়াল যেন দুজনের মাঝে দাঁড়িয়ে গেছে। অভিমান আর ভুল বোঝাবুঝি সেই দেয়ালকে আরও শক্ত করে তুলল।
একদিন বিকেলে মন খারাপ করে নীলা তাদের সেই পুরনো ইউনিভার্সিটির লেকের পাড়ে এসে বসল। যেখানে আকাশ প্রথম তার হাত ধরেছিল। হঠাৎ কাঁধে একটা পরিচিত স্পর্শ পেয়ে সে চমকে উঠল।
ফিরে দেখে, আকাশ দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখেমুখে রাজ্যের ক্লান্তি, কিন্তু দৃষ্টিতে গভীর ভালোবাসা আর অপরাধবোধ।
আকাশ নীলার পাশে বসে বলল, "আমি জানি আমি ভুল করেছি, নীলা। আমি একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ বানানোর লোভে আমাদের বর্তমানটাকে নষ্ট করে ফেলছিলাম। আমি এমন একটা বাড়ি বানানোর জন্য দৌড়াচ্ছিলাম, যার ভিতটাই আমি নিজের অজান্তে দুর্বল করে দিচ্ছিলাম।"
নীলার অভিমানী মন তখনও শান্ত হয়নি। সে অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, "দূরত্বটা শুধু মাইলের নয়, মনেরও হয়। আমি সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি।"
আকাশ নীলার হাতটা নিজের হাতে তুলে নিয়ে বলল, "আমি সেই মনের দূরত্বটা শেষ করতে এসেছি। চাকরি, শহর, উন্নতি—এসবের কোনো অর্থ নেই যদি তুমিই পাশে না থাকো। আমি বুঝতে পেরেছি, ভালোবাসা শুধু একসাথে স্বপ্ন দেখা নয়, কঠিন সময়ে একে অপরের শক্তি হওয়াও বটে। আমি সেই শক্তি হতে পারিনি। আমাকে মাফ করে দেবে?"
নীলার চোখের জল এবার আর অভিমানের ছিল না, ছিল ভালোবাসার। সে আকাশের কাঁধে মাথা রেখে ফিসফিস করে বলল, "ভালোবাসা মানে তো শুধু কাছে থাকাই নয়, দূরে থেকেও ভরসা রাখা। আমি হয়তো সেই ভরসাটা রাখতে পারিনি।"
সেদিন লেকের পাড়ে বসে তারা কোনো নতুন স্বপ্ন দেখেনি, বরং পুরনো স্বপ্নগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার শপথ নিয়েছিল। তারা বুঝতে পেরেছিল, প্রেমের প্রথম পর্বটা হয় আবেগের, কিন্তু দ্বিতীয় পর্বটা হয় বিশ্বাস, ধৈর্য আর বোঝাপড়ার।
তাদের গল্পটা হয়তো নিখুঁত নয়, কিন্তু বাস্তব। কারণ ভালোবাসা মানে শুধু বসন্তের কোকিল নয়, ঝড়ের রাতে একে অপরের আশ্রয় হয়ে ওঠাও বটে। আর নীলা ও আকাশ সেই আশ্রয় খুঁজে পেয়েছিল একে অপরের মাঝে, নতুন করে।
(সমাপ্ত)
0 Comments